Saturday, April 4, 2020

আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ


কিছুদিন আগে আমার এক রসিক বন্ধু ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, “তোমার বিয়ের সময় তুমি বরযাত্রীদের নিজেই রাইড দিয়ে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে হাইওয়েতে এক-একটা এক্সিট দেখিয়ে র‍্যানডম ক্যুইজ করবে, ‘বলুন তো, এই এক্সিটটা কোথায় গেছে?’ যখন কেউ কিছু বলতে পারবে না, তুমি বলবে, ‘আরে ভাবুন ভাবুন, কমন সেন্স অ্যাপ্লাই করুন। আর একান্তই বলতে না পারলে চলুন গিয়েই দেখা যাক এই এক্সিটটা কোথায় গেছে। আমি সেদিন এইভাবেই একটা এক্সিট ধরে টু পয়েন্ট থ্রি থ্রি মাইল গিয়ে একটা স্টেট পার্ক খুঁজে পেয়েছিলাম।’ ”

গাড়ি হাঁকিয়ে নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া আর রাস্তাঘাট মুখস্ত করে ফেলা আমার একটা অদ্ভুত শখ। এখন করোনার দাপটে এখানে ‘স্টে ইন শেল্টার’ চলছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো বারণ। গাড়ি চালিয়ে যাওয়া বলতে শুধু গ্রোসারি, সেটাও বড়জোর সপ্তাহে একবার। আবার যে কবে লং ড্রাইভে যেতে পারব, কে জানে! অ্যাপার্টমেন্টের চার দেওয়ালের গন্ডীর মধ্যে বসে থেকে মনটা নিমেষে চলে যায় ছোটবেলায়। জীবনের প্রথম নয় বছর যে বাড়িতে কাটিয়েছি, সে বাড়ি থেকে এক মিনিটের হাঁটায় যশোহর রোড। সকাল থেকে রাত যে কোন সময় বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়ালেই শোনা যেত বাসওয়ালাদের হাঁক -

“সীট খালি সীট খালি বেলেঘাটা শিয়ালদা মৌলালি ধর্মতলা সীট খালি”
“হাওড়া হাওড়া খান্না মানিকতলা বাগুইআটি কেষ্টপুর লেকটাউন উল্টোডাঙা গিরিশপার্ক বড়বাজার হাওড়া হাওড়া হাওড়া”
“জাগুলি জাগুলি গাদামারা ময়না আমডাঙা কামদেবপুর আবালসিদ্ধি জাগুলি”
“দক্ষিণেশ্বর দক্ষিণেশ্বর নাগেরবাজার দমদম সিঁথিরমোড় বরানগর ডানলপ দক্ষিণেশ্বর”  

ঘোরার পোকাটা মাথায় ছোট থেকেই নড়ত। ইচ্ছে হত বাড়ির কাছের বাসস্টপে যতগুলো রুটের বাস থামে, স-ব রুটে ঘুরে ঘুরে জায়গাগুলো আর রাস্তাগুলো চিনে আসি। বয়স কম, একা তো যেতে পারব না, কাউকে সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু অন্য কাউকে বলতে ঠিক ভরসা হত না। এরকম আজগুবি শখ কারো আবার হয় নাকি! আর বাসের অত ভাড়াই বা দেবে কে! তাই ছোটবেলায় ওইভাবে ঘোরাটা আর হয়নি।

বি টেক করছি। থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে উঠব। ইন্টার্নশিপ করতে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালোর। ওখানকার বাসে ডে-পাস বলে একটা ব্যাপার আছে। সেটা দু’হাজার দশ সাল। তখন নন-এসি বাসে কুড়ি টাকা আর এসি ভলভো বাসে পঞ্চান্ন টাকায় ডে-পাস পাওয়া যেত। মানে একবার পাস কিনলে ওটা নিয়েই সারা দিন যত খুশি ঘোরা যায়। দ্বিতীয়বার আর টিকিট কাটার দরকার নেই। এক শুক্রবার হল কি, সন্ধ্যেয় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ব্যাগটা রেখেই বেরিয়ে গেলাম। যাব কোথায়?  অনেক বাসে দেখেছি ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা থাকে হয় ‘বনশঙ্করী’ নাহলে ‘কে বি এস’। ‘কে বি এস’ অর্থাৎ ‘কেম্পেগৌড়া বাস স্টেশন’ এর সাথে অনেকে আবার জুড়ে দেয় ‘ম্যাজেস্টিক’। ‘বনশঙ্করী’ আর ‘ম্যাজেস্টিক’ – এই দুটো জায়গা চিনে আসতে হবে। রাতে বাড়ি ঢুকতেই রুমমেটদের একজন জিজ্ঞেস করল, “অফিস থেকে ফিরেই দুম করে বেরিয়ে গেলি, কোথায় গিয়েছিলি?” সোৎসাহে বলে উঠলাম, “জানিস জানিস, বাসে বাসে করে ঘুরলাম। একটা বাসে এখান থেকে বনশঙ্করী, আরেকটা বাসে বনশঙ্করী থেকে ম্যাজেস্টিক, আবার আরেকটা বাসে ম্যাজেস্টিক থেকে এখানে। জানিস একটা পয়সাও এক্সট্রা লাগেনি। ডে-পাসেই হয়ে গেল।” সে বেচারা বুঝতে পারল না কি বলবে। হয়ত আশা করে ছিল শুনবে কারো সাথে ডেট এ গিয়েছিলাম, তার বদলে এ কী শুনল! পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে শুনলাম সেই ছেলেটা বাকি রুমমেটদের গল্পটা বলছে। বাকিরাও বুঝতে পারছে না হাসবে না কাঁদবে।

জায়গা চেনা আর রাস্তা চেনার এই নেশা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে এসেও যায়নি। বরং বেড়ে গেছে আরো। টেক্সাস এ-এন্ড-এম এ প্রথম সেমেস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হল, সেদিন আবার বাড়ি এসে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যাম্পাসে যতগুলো বাসরুট আছে, সবগুলোয় চড়ে দেখতে হবে কোন বাস কোথায় যায় আর কোথায় কোথায় থামে। অনলাইনে ম্যাপে সেটা দেওয়া থাকে ঠিকই, কিন্তু থিওরি আর প্র্যাকটিক্যালের মধ্যে একটা তফাৎ আছে। নিজে না গেলে শুধু ম্যাপ দেখে মনে রাখা যায় না। সেদিনটা ভালই যাচ্ছিল, কিন্তু একবার একটা বাসের লাস্ট স্টপে না নেমে বসে ছিলাম ওই বাসেই ফিরব বলে। বাকি যাত্রীরা তার আগের স্টপে নেমে গিয়েছিল, তাই বাসে অন্য কোন যাত্রী ছিল না। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “এটাই লাস্ট স্টপ। তুমি শিওর এখানে নামবে না?” ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিটা যে ভয়েই বলতে পারব না। কি বলব! ড্রাইভার কি ভাবছে! কোনমতে ‘ও সরি, আমি খেয়াল করি নি’ বলে নেমে গিয়েছিলাম। পরের বাসে ফিরেছিলাম। তারপর এরকমভাবে বাসে করে আর কখনও ঘুরিনি। হেঁটেই ঘুরতাম।

ঘুরতে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছি; যে শহরে থাকি সেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট একরকম নেই বললেই চলে, অথচ গাড়ি চালানো শিখতে প্রচন্ড ভয়। ছোটবেলায় বাসে উঠে সুযোগ হলেই ড্রাইভারের পাশে বসতাম। লক্ষ্য করতাম কিভাবে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে। ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ-রিভার্স কখন কোন গিয়ার দিচ্ছে। গিয়ার বদলানো, অ্যাক্সিরালেটর বা ব্রেকে চাপ দেওয়া, কখন কিরকম শব্দ হয় – তার নকল করেছি বহু বছর। কিন্তু খেলাচ্ছলে চালানো আর সত্যি সত্যি চালানোর মধ্যে বিরাট তফাৎ। গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে জানলাম স্টিয়ারিং এ হাত দেওয়ার আগে নিয়মকানুন শিখে লার্নার্স পারমিট পেতে হবে। প্রথম যখন দেখলাম এত গাদাগুচ্ছ নিয়ম মুখস্ত রাখতে হবে, মনে হয়েছিল আমার দ্বারা হবে না। একটার পর একটা মডিউল আসত নিয়মকানুনের, আর ভাবতাম মানুষ এত কি করে মনে রাখে। খাতায় নোটস বানিয়ে, ডায়াগ্রাম এঁকে, বারবার করে আউড়ে – কিছুতেই কিছু হত না। পরের দিন দেখতাম সব ভুলে গেছি। এভাবে দু’বছর চলেছে। দু’বছর? হ্যাঁ, দু’বছর।

প্রথম যেদিন ‘হাতে স্টিয়ারিং’ হ’ল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি নার্ভাস ব্রেকডাউন হ’ল বলে। পার্কিং লটে দু’ঘণ্টা শুধু গাড়ি ডানদিকে কিভাবে ঘোরায় তাই প্র্যাকটিস করেছি, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে কিছু না কিছু ভুল হল। কয়েকদিন পর যখন পার্কিং লটে প্র্যাকটিস করতে গেছি বাঁদিকে কিভাবে ঘোরায়, তখন মনে হচ্ছিল ডানদিকে ঘোরানোটা তাও যা পারছিলাম, এটা তো আরোই পারছি না। এরকমভাবে কয়েকমাস চলেছে। যে-ই শেখাচ্ছে, তার-ই প্রাণ ওষ্ঠাগত। খুব প্রিয় একজন মানুষ মজা করে বলেছেন, “যেদিন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোবে, বেরোনোর আগে আমাকে মেসেজ করে দেবে। সেদিন আমি আর বেরোব না।” নিজের গাড়ি বাড়ি নিয়ে এসেছি কোন এক মঙ্গলবার, কিন্তু শনিবারের আগে চালাতে বেরোইনি ভয়ে। যদি কিছু হয়ে যায়। তার কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। তখন শহরের রাস্তায় মোটামুটি পারছি, কিন্তু হাইওয়েতে কখনও উঠিনি। একবার একজনের বাড়ি যাচ্ছিলাম কিছু বই আনতে। হাইওয়ে দিয়ে কয়েক মাইল যেতে হত। ভয়ে হাইওয়েতে উঠিইনি। হাইওয়ের পাশের রাস্তা, যেটাকে আমেরিকায় ফ্রন্টেজ রোড বলে, সেটা দিয়েই গেছি এসেছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। মনে হল, হাইওয়েতে ওঠাটা একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটা আমি নিতে পারব না? একবার চেষ্টা করে দেখি না। প্রথমবার হাইওয়েতে উঠলাম, গেলাম পাঁচ মাইল, ফিরলাম পাঁচ মাইল। ঘণ্টায় সত্তর মাইলে মানুষ চালাচ্ছে কি করে! আমার তো স্পিড ষাটের উপর উঠলেই বুক ধড়ফড় করে উঠছে। আবার মনে হল, আরেকবার যাই। একটু দম নিয়ে আবার গেলাম। সেদিন এইভাবে তিনবার যাওয়া আসা করেছি হাইওয়েতে। তৃতীয়বার মনে হল, নাহ এইবার আর আগের মত দম আটকে আসছে না। বুঝলাম, বার বার প্র্যাকটিস করতে থাকলে গাড়ি চালানো জিনিসটা আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে।

শুরু হ’ল প্র্যাকটিস। একটা সময় এল, যখন ম্যাপ দেখে ভেবে নিতাম আজ এই রুটটায় যাব। সেই রুটটায় ঘুরে আসতাম। পরের বার ভাবতাম, আগেরদিন এই এক্সিটটা নিয়ে বাঁদিকে চলে গিয়েছিলাম। বাঁদিকে না গিয়ে ডানদিকে যদি যেতাম, তাহলে কোথায় পৌঁছতাম? বা যদি সোজাই চলে যেতাম, তাহলেই বা কোথায় যেতাম? কখনও বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ম্যাপে দেখে নিয়ে, কখনও আবার না দেখেই বেরিয়ে যেতাম। কতবার এরকম হয়েছে যে হয় ম্যাপ দেখে না হয় রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডগুলো দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, “ও তাই! এই রাস্তাটা অমুক জায়গায় গেছে! গিয়ে দেখি তো!” এইভাবেই চলে গেছি লেক সমারভিল, লেক কনরো, স্যাম হিউস্টন ন্যাশনাল ফরেস্ট, ডেভি ক্রকেট ন্যাশনাল ফরেস্ট। হিউস্টন-অস্টিন-স্যান অ্যান্টোনিওর মত বড় শহরের পাশাপাশি চলে গেছি ছোটবেলার আমডাঙা-কামদেবপুর-নাগেরবাজার-বাগুইআটির মত রোনস প্রেইরি, হান্টসভিল, ম্যাডিসনভিল, সেন্টারভিল, মার্লিন, ওয়েকো, ইন্ডিপেন্ডেন্স, ব্রেনহ্যাম, বেলভিল, সিলি, লা গ্র্যঞ্জ, গিডিংস, রকডেল, টেইলর, ফ্রাঙ্কলিনের মত ছোট-মাঝারি অনেক শহরে। দূরপাল্লার রোড ট্রিপে গেছি – কখনও তিন জন, কখনও চার জন, কখনও পনেরো জন, আবার কখনও একা। যে স্টিয়ারিং এ হাত দিতে একদিন ভয়ে বুক কেঁপে যেত, আজ সেই স্টিয়ারিং এ মাঝে মাঝে বসতে না পারলে কেমন খালি খালি লাগে।  

ভবিষ্যতে যদি সময়-সুযোগ হয়, স্টিয়ারিং এ বসে ঘুরতে চাই বোস্টন থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো, ভ্যানকুভার থেকে টোরন্টো, কায়রো থেকে কেপটাউন, পার্থ থেকে সিডনি, মস্কো থেকে সাইবেরিয়া, আর অতি অবশ্যই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল। এই মুহূর্তে হয়ত পাগলের প্রলাপের মত শোনাচ্ছে। তা শোনাক। স্বপ্ন যতক্ষণ স্বপ্ন থাকে, বাস্তবে পরিণত না হয়, ততক্ষণ ওরকমই শোনায়। একদিন হয়ত এরকমই কোন একটা হাইওয়েতে ঘুরতে ঘুরতে পাশের সীটের সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করব, “বলুন তো, এই এক্সিটটা কোথায় গেছে?”   

আপাততঃ পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। সবাই ভাল থাকবেন। সাবধানে থাকবেন।